বাংলার ইতিহাসে হরিচাঁদ ঠাকুর ও গুরুচাঁদ ঠাকুর ঠাকুরের আবদান আবদান



বাংলার ইতিহাসে হরিচাঁদ ঠাকুর ও গুরুচাঁদ ঠাকুর ঠাকুরের আবদান

প্রাচীন বাংলার এক বিখ্যাত ধর্মগুরু ,দার্শনিক , গৌতম বুদ্ধদেব ও শ্রী চৈতন্যদেবের যুগপৎ অবতার,অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন, জাতিভেদ বিরোধী, মনীষী, মহামানব, মহান গুরু,মতুয়াবাদ প্রতিষ্ঠাকারি, দলিত,নমঃ(শূদ্র)দের ত্রাণকর্তা, এক কিংবদন্তী ছিলেন শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর গুরুচাঁদ ঠাকুর |

গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানী থানার অন্তর্গত ওঢ়াকাঁন্দির সফলাডাঙ্গা গ্রামে প্রায় দুশো বছর আগে ১২১৮ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন মাসে (১৮৪৬ সালের ১৩ মার্চ) শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর জন্মগ্রহণ করেন। পিতা যশোবন্ত ঠাকুর ও মাতা অন্নপূর্ণা দেবী। যশোবন্ত নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের ছিলেন। বৈষ্ণবভক্ত হিসেবেও এলাকায় তিনি বেশ পরিচিত ছিলেন। হরিচাঁদ ঠাকুর জন্মেছিলেন এক মাহেন্দ্রক্ষণে। জন্মের সময় তাঁর শরীরে বত্রিশ রকমের লক্ষণ ছিল, যা হিন্দুশাস্ত্র অনুযায়ী অবতার পুরুষের বিশেষ লক্ষণ। এই লক্ষণগুলি গৌতম বুদ্ধের শরীরেও ছিল। অনেকেই মনে করেন হরিচাঁদ ঠাকুর আসলে বুদ্ধদেব ও শ্রী চৈতন্যদেবের যুগপৎ অবতার।

হরিচাঁদ ঠাকুর অত্যন্ত সাদামাটা জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার সুযোগ পাননি।

প্রথম জীবনে হরিচাঁদ ঠাকুর মাঠে গরু চরাতেন।

অলৌকিক ক্ষমতাবলে তিনি ভক্তদের রোগ থেকে মুক্ত করাসহ বিভিন্ন কল্যাণসাধন করতেন। ধীরে ধীরে হরিচাঁদ ঠাকুরের ভক্তসংখ্যা বাড়তে থাকে। হরিভক্তদের মতুয়া বলা হয়।

মতুয়াদের ভক্তি ও হরিচাঁদ ঠাকুরের শক্তি এ দুয়ে মিলে ওড়াকান্দি ক্রমান্বয়ে দেশে দেশে পরিচিত হয়ে ওঠে। বর্তমানে ওড়াকান্দি একটি তীর্থধামে পরিণত হয়েছে।


পতিতজনের মুক্তির পন্থা দান করাকে হরিচাঁদ ঠাকুর তাঁর অবতার গ্রহণের অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন। অন্যদিকে বলা যায় নিম্নবর্গীয় জনগোষ্ঠীর আত্মমর্যাদা বৃদ্ধি এবং তাদের আর্থ-সামাজিক মুক্তির বিষয়টি তাঁকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিলো।

ভক্তদের প্রতি তাঁর প্রধান উপদেশ ছিল, ‘হাতে কাজ’ মুখে নাম ।

দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এই মনীষী মাত্র ৬৬ বছর বয়সে ১৮৭৭ ,২৩ ফাল্গুন ইহলোক ত্যাগ করেন।

মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁর ঠাকুরবাড়ি ও মতুয়া ধাম বর্তমানে একটি গুরুত্বপূর্ণ তীর্থ কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। ভারতের ঠাকুরনগর ও গোপালগঞ্জ ওড়াকান্দিতে এ উপলক্ষে লাল নিশান উড়িয়ে, জয়ডাঙ্কা বাজিয়ে, সিঙ্গা ফুঁ দিয়ে হিন্দু-মুসলমান-খ্রিষ্টান-বৌদ্ধ ভক্তরা যোগ দেয়। হরিচাঁদ ঠাকুর মানবতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুর

পিতা ছিলেন মতুয়া আন্দোলনের সূচনাকারী হরিচাঁদ ঠাকুর। সামাজিক বৈষম্যের কারনে গুরুচাঁদ কোনো বিদ্যালয়ে ভর্তি না হতে পারলে পিতা হরিচাঁদ তাকে মাদ্রাসায় ভর্তি করেন ও পরামর্শ দেন ভবিষ্যতে শিক্ষার উন্নতি করার। পিতার মৃত্যুর পর এই সামাজিক আন্দোলনের দায়িত্ব নেন গুরুচাঁদ।

অনুন্নত শ্রেনীর শিক্ষাবিস্তার ও জীবনযাত্রার মানোন্নয়ননের ওপর বিশেষভাবে জোর দেন গুরুচাঁদ ঠাকুর। সামাজিক ও বর্ণহিন্দুর বাধা অতিক্রম করে ১৮৮০ সালে ওড়িয়াকান্দিতে প্রথম বিদ্যালয় স্থাপন করেন। তার উৎসাহে ১৮ বছরের মধ্যে এটি প্রাথমিক স্তর হতে উচ্চ বিদ্যালয়ে উন্নিত হয়। অস্পৃশ্যতা দুরীকরণ ও শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে গণ আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন তিনি। ৯০ বছরের জীবনে ১৮১২ টি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে।[১] ১৮৮১ সালে তার উদ্যোগে ও সভাপতিত্বে খুলনার দত্তডাঙায় প্রথম নমঃশূদ্র মহা সম্মেলন হয়। চন্ডাল জাতিকে নমশুদ্র জাতিতে উত্তরনের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। তার চেষ্টায় একটি প্রতিনিধিদল ১৯০৭ সালে বাংলা ও আসাম গভর্নর জেনারেলের কাছে এই মর্মে প্রতিবেদন পেশ করেন। যার সাফল্যস্বরূপ ১৯১১ সালের নমশূদ্র নামটি পরিচিতি লাভ করেছিল। তার মৃত্যুর পর এই আন্দোলনের দায়িত্ব নেন রাজনীতিবিদ ও সাংসদ প্রমথরঞ্জন ঠাকুর। দেশবিভাগের পর মতুয়া মহাসঙ্ঘের প্রধান কেন্দ্র গড়ে ওঠে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার ঠাকুরনগরে।

আর গুরুচাঁদ শুধু পিছিয়েপড়া হিন্দু জাতির জন্য কাজ করেননি। তিনি মূলত মানুষের জন্য কাজ করে গেছেন। তিনি সবাইকে মানুষ হিসেবে দেখতেন। তার কাছে কোনো জাতিভেদ ছিল না। তাই তাঁর পরমপ্রিয় ভক্ত হয়েছিলেন খুলনার তিনকড়ি মিঞা। তার নাতি জালালউদ্দিন বর্তমানে মতুয়া দলপতি। বিদেশি দম্পতি ডা. এস এস মিড তাকে ডেকেছিলেন ধর্মপিতা। ধর্মযোগী হরিচাঁদ ঠাকুর মতুয়াধর্মের মাধ্যমে অবহেলিতদের সঙ্ঘবদ্ধ করেছিলেন।

দলিত সমাজের সাধারণ একজন মানুষ নিজের জাতির কথা চিন্তা করে নিজের উদ্যোগে স্কুল প্রতিষ্ঠা করে এক নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। এ স্কুলেই প্রথম তিনি ছাত্রবৃত্তি চালু করেন।

তাই তিনি খ্রিস্টান মিশনারি ড. মিডের সহায়তা নেন এবং সরকারি সাহায্যে ১৯০৮ সালে ওড়াকান্দির মিডল ইংলিশ স্কুলকে হাই ইংলিশ স্কুলে পরিণত করেন। ১৮৮১ সালে খুলনার দত্তডাঙ্গায় এক নমঃশূদ্র মহাসম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ঈশ্বর গায়েনের বাড়িতে।

সেখানে দলিত সমাজে শিক্ষা প্রসারের প্রয়োজনীয়তা ও উপায় সম্বন্ধে তিনি শতাব্দীর সেরা ভাষণ দেন। এর পর থেকেই তিনি একের পর এক স্কুল স্থাপন করতে থাকেন।

১৯৩২ সালে গুরুচাঁদ ঠাকুর ‘শ্রীশ্রীহরি-গুরু মিশন’ স্থাপন করেন। এই মিশনের মাধ্যমে তিনি গ্রামে গ্রামে রাস্তাঘাট, পাঠশালা, স্কুল ও ছাত্রাবাস স্থাপনের ব্যবস্থা করেন।

এছাড়া মিসেস মিডের সহযোগিতায় ১৯০৮ সালেই মেয়েদের জন্য একটি শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে তোলা হয়। প্রসূতি মা ও শিশুসেবার জন্য নির্মিত হয় মাতৃমঙ্গল কেন্দ্র, যা আজও ওড়াকান্দিতে কালের সাক্ষী হয়ে আছে।

আজ থেকে প্রায় ২০০ বছর আগে এই মনীষী যে আধুনিক চিন্তা করেছিলেন, আজও তা অব্যাহত রয়েছে মানবসমাজে।

১৯১৯ সালেই নতুন ভারত শাসন আইন প্রবর্তিত হয় এবং তাতে অস্পৃশ্যদের রাজনৈতিক অধিকার মেনে নেওয়া হয়। এরই ফলে বাংলার বিধান পরিষদে সর্বপ্রথম প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পান গুরুচাদের অনুসারী ভীষ্মদেব দাস। ১৯২১ সালে বাংলার বিধান পরিষদে ১৩৯ জন সদস্যের মধ্যে মাত্র দুজন ছিলেন অস্পৃশ্য সমাজের।

১৮৫৮ সালে কৃষক বিদ্র্রোহ এবং ১৮৫৯-৬০ সালে নিম্নশ্রেণীর কৃষকদের মধ্যে নীল বিদ্রোহ হয়। এ সময় শক্তিশালী জমিদাররা কৃষকদের ওপর অকথ্য অত্যাচার চালাচ্ছিল। এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন হরিচাঁদ ঠাকুর। ১৮৭২-১৮৭৬ সাল পর্যন্ত পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে জমিদার ও তাদের অনুচরদের সংঘবদ্ধ কৃষকেরা আক্রমণ করে। আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন গুরুচাঁদ ঠাকুর। গুরুচাঁদ ঠাকুর ছিলেন মূলত দলিত পিছিয়ে পড়া সমাজের পথিকৃৎ। তিনি এই পিছিয়ে পড়া সমাজকে শিক্ষার আলো জ্বেলে অগ্রগামী করেছিলেন। তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় তিনি শুধু গোপালগঞ্জ নয়, ভারতবর্ষেও বহু পিছিয়ে পড়া মানুষের মধ্যে শিক্ষার আলো জ্বেলেছেন। এসব দলিত মানুষকে মানুষ হিসেবে ভাবতে শিখিয়েছেন। কিন্তু ২০০ বছর পরে এসে আমরা দেখছি গুরুচাঁদ ঠাকুরের স্বপ্ন এখনো পূরণ হয়নি। এখনো নিম্নবর্ণের জেলা হিসেবে কাশিয়ানীতে উন্নতির ছোঁয়া পড়েনি।

১৯৩৮ সালে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির সভাপতি হিসেবে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু গুরুচাঁদ ঠাকুরকে একজন মহামানব হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। মহাত্মা গান্ধী গুরুচাঁদ ঠাকুরকে বলেছিলেন মহান গুরু। প্রতি বছর চৈত্র মাসের মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশীতে হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মতিথিতে তিনি দিন বরুনীমেলা অনুষ্ঠিত হয়। ভারতের ঠাকুরনগর ও ওড়াকান্দিতে এ উপলক্ষে লাল নিশান উড়িয়ে, জয়ডাঙ্কা বাজিয়ে, সিঙ্গা ফুঁ দিয়ে হিন্দু-মুসলমান-খ্রিষ্টান-বৌদ্ধ ভক্তরা যোগ দেয়। গুরুচাঁদ ঠাকুর মানবতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

হরিচাঁদ ঠাকুরের সমগ্র জীব ও মানব জাতির উদ্দেশ্যে বলা বাণী




জীবে দয়া নামে রুচি, মানুষেতে নিষ্ঠা।
ইহা ছাড়া আর যত সব ক্রিয়া ভ্রষ্টা।।

সব ধর্মের উর্ধে হচ্ছে মানব ধর্ম।

সেটাই সবার সেরা ধর্ম।


নীচ হয়ে করিব যে নীচের উদ্ধার।

অতি নিম্নে না নামিলে কিসের অবতার।।



করিবে গৃহস্থ ধর্ম লয়ে নিজ নারী।

“পরনারী মাতৃতুল্য মিথ্যা নাহি কবে।
পর দুঃখে দুঃখী সচ্চরিত্র সদা রবে।।



“হাতে কাম, মুখে নাম।”

যত যত তীর্থ আছে অবনী ভিতরে।

“যে যাহারে ভক্তি করে সে তার ঈশ্বর।”


“বিশ্ব ভরে এই নীতি দেখি পরস্পর।
যে যাহারে উদ্ধার করে সে তার ঈশ্বর।।”

“ঠাকুর কহেন বাছা ধর্ম কর্ম সার।
সর্ব ধর্ম হ’তে শ্রেষ্ঠ পর উপকার।।”


“অঙ্গ ধৌত বস্ত্র ধৌত ছাপা জপমালা।
বহিরঙ্গে বাহ্য ক্রিয়া সব ধুলা খেলা।।
যত দিন নাহি ঘুচে চিত্ত অন্ধকার।

“খাও বা না খাও তা’তে কোন দুঃখ নাই।
ছেলে পিলে শিক্ষা দেও এই আমি চাই”।।

ছেলে মেয়েকে দিতে শিক্ষা
প্রয়োজনে করিবে ভিক্ষা।


তাই বলিভাই মুক্তি যদি চাই
বিদ্যান হইতে হবে।
পেলে বিধ্যাধন দুঃখ নিবারণ
চির সুখি হবে ভবে।।


শিক্ষা আন্দোলন যবে প্রভু করে দেশে।
ভক্‌ত সুজন যত তার কাছে আসে।।


নমঃশূদ্র তেলী মালী আর কুম্ভকার।
কপালী মাহিষ্য দাস চামার কামার।।
পোদ আসে তাতী আসে আসে মালাকার।
কতই মুসলমান ঠিক নাহি তার।।


সাবাকে ডাকিয়া প্রভু বলে এই বাণী।
“শুন সবে ভক্তগণ আমি যাহা জানি।।
নমঃশূদ্রকুলে জন্ম হয়েছে আমার।
তবু বলি আমি নাহি নমঃর একার।।
দলিত পীড়িত যারা দুঃখে কাটে কাল।
ছুঁস্‌নে ছুঁস্‌নে বলে যত জল-চল।।


শিক্ষা-হারা দীক্ষা-হারা ঘরে নাহি ধন।
এই সবে জানি আমি আপনার জন।।” -

নারী পুরুষ পাবে সম অধিকার।।


সমাজে পুরুষ পাবে যেই অধিকার।
নারীও পাইবে তাহা করিলে বিচার।।


“শুন কন্যা, গুণে ধন্যা, আমার বচন।
জাতি-ভাগ মোর ঠাঁই পাবে না কখন।।
নরাকারে ভূমন্ডলে যত জন আছে।
‘এক জাতি’ বলে মান্য পাবে মোর কাছে।।


আমার পিতার ভক্ত আছে যত জন।
এক জাতি বলে তারা হয়েছে গণ।।
লোকাচারে তার কেহ কায়স্থ ব্রাহ্মণ।
‘মতুয়ার’ মধ্যে তাহা নাহি নিরূপণ।।

নমঃশূদ্র, তেলী মালী, ব্রাহ্মণ কায়স্থ।
ইস্‌লাম, বৈদ্য জাতি-রোগে সিদ্ধ-হস্ত।।
মতুয়া সকলে এক, জাতি-ভেদ নাই।
বিশেষতঃ কন্যা হ’লে নাহিক বালাই।।

কুকুরের উচ্ছিষ্ট প্রসাদ পেলেও খাই।
বেদ বিধি শৌচাচার নাহি মানি তাই।।

কোথায় ব্রাহ্মণ দেখ, কোথায় বৈষ্ণব।
স্বার্থ বসে অর্থ লোভী যত ভন্ড সব।।


“ব্রাহ্মণ রচিত যত অভিনব গ্রন্থ।
‘ব্রাহ্মণ প্রধান’ মার্কা বিজ্ঞাপন যন্ত্র।।



“যে যাহারে ভক্তি করে সে তার ঈশ্বর।
ভক্তিযোগে সেই তার স্বয়ং অবতার।।”


“মানবকুলে আসিয়ে, যশোমন্ত সুত হ’য়ে,
জন্ম নিল সফলানগরী।
প্রচারিল গূঢ়গম্য, সূক্ষ্ম সনাতন ধর্ম,
জানাইল এ জগত ভরি।।”


“বহুত দ্বাপর কলি আসে আর যায়।
স্বয়ং এর অবতার তাতে নাহি হয়।।
অষ্টাবিংশ মন্বন্তর শেষ যেই কলি।
অবতীর্ণ ভক্তবৃন্দ লইয়া সকলি।।”

“আর এক জন্ম বাকী রহিল প্রভুর।
এই সেই অবতার শ্রীহরি ঠাকুর।।”

“কিসের রসিক ধর্ম কিসের বাউল।
ধর্ম যজে নৈষ্ঠিকেতে অটল আউল।।

সর্ব ধর্ম লঙ্ঘি এবে করিলেন স্থুল।
শুদ্ধ মানুষেতে আর্তি এই হয় মূল।।
জীবে দয়া নামে রুচি মানুষেতে নিষ্ঠা।



ইহা ছাড়া আর যত সব ক্রিয়া ভ্রষ্টা।।
এই সুক্ষ্ম সনাতন ধর্ম জানাইতে।
জনম লভিলা যশোমন্তের গৃহেতে।।”

..
“রামকান্ত বলে মাগো বলি যে তোমারে।
বাসুদেব জন্মিবেন তোমার উদরে।।”


“কৃষ্ণ প্রেম সুনির্মল উচ্চেতে না র’বে।
নিম্ন খাদে থাকে বারি দেখ মনে ভেবে।।”



“এই মত দেখ নানা কারণ বশতঃ।
গোলক বিহারী হ’ল যশোমন্ত সুত।।”



ধন্য অন্নপূর্ণা হেন পুত্র পেল কোলে।
দ্বাপরে যশোদা যিনি ছিলেন গোকুলে।।
দ্বাপরে ছিলেন নন্দ যশোদার কান্ত।
যশোমতি কান্ত এবে হ’ল যশোমন্ত।।


ধরা দ্রোণ দুইজন তস্য পূর্ব্বে ছিল।
নন্দ যশোমতি তেই দ্বাপরে হইল।।
কলিকালে জগন্নাথ মিশ্র শচীরাণী।
এবে যশোমন্ত অন্নপূর্ণা ঠাকুরাণী।।”


আমার মনের কথা কেমনে জানিলে।।
আমি যে এনেছি বিষ গোপন করিয়া।
কেহ নাহি জানে আনি কাপড়ে বাঁধিয়া।।
গোপনে রেখেছি কিসে পাইল সন্ধান।
অন্তর্যামী ইনিত স্বয়ং ভগবান।।

মহাপ্রভু ডেকে বলে সেই হীরামনে।
রামাবতারের কথা পড়ে তোর মনে।।
লংকাদগ্ধ বনভঙ্গ সাগর লঙ্ঘন।
রাজপুত্র বনবাসী নারীর কারণ।।

ভেবে দেখ মনে তাহা হয় কিনা হয়।
যে সকল কার্য্য বাছা করিলি ত্রেতায়।।
প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ বিরূপাক্ষ সমুদ্ভব।
দ্বিতীয় মহান রুদ্র অযোনী সম্ভব।।

তৃতীয়ে শ্রীহনুমান রামনাম অঙ্গে।
চতুর্থে মুরালীগুপ্ত শচীসুত সঙ্গে।।
পঞ্চমে তুলসীদাস ষষ্ঠে হীরামন।
আদি হি, অন্ত ন, মধ্যে রাম নারায়ণ।।


হনুমান দ্বীনকার এ কোন কারণ।
হীন হ’য়ে হীন মধ্যে শ্রীরাম স্থাপন।।

মহাপ্রভুর শ্রীরাম মূর্তি ধারণ প্রবন্ধে,
অভিনব রূপ নব দূর্বাদল শ্যাম।
দেখিতে দেখিতে হ’ল দাশরথি রাম।।

আর যত লোক ঠাকুরের ঠাই ছিল।
সবে দেখে প্রভু হরিচাঁদ দাঁড়াইল।।
হীরামন দেখিল সাক্ষাৎ সেই রাম।
শিরে জটা বাকলাটা সুন্দর সুঠাম।।


একা হীরামন দেখে রাম দয়াময়।
সে রূপের আভা মাত্র দেখে মৃত্যুঞ্জয়।।
বামপার্শ্বে কুক্ষিমধ্যে দেখে ধনুর্গুণ।
কটিতে বাকল শিরে জটা কক্ষে তুণ।।


বনবাসে যেই বেশে যান ঋষ্যমুখে।
তেম্নি অপরূপ রূপ হীরামন দেখে।।
পুনরায় রামরূপ হীরামন দেখতে চাইলে,
হীরামন বলে কোথা পূর্ণব্রহ্ম রাম।


হীরামন বলে প্রভু মোরে দেখা দাও।
আরবার রামরূপ আমারে দেখাও।।
প্রভু কহে কহি তোরে ওরে হীরামন।
যদি কেহ কারু কিছু করে দরশন।।
অস্মভব দেখে জ্ঞানী প্রকাশ না করে।
শুনিলে সন্দেহ হয় লোকের অন্তরে।।


তব শ্রীমুখের আজ্ঞা যদি পায় হীরে।
ব্রহ্মাণ্ড ডুবা’তে পারে গোষ্পদের নীরে।।
ত্রেতাযুগে তব শ্রীমুখের আজ্ঞা পাই।
আঠার বর্ষের পথ এক লম্ফে যাই।।
আনিনু গন্ধমাদন তব কৃপাগুণে।


হীরামন বলে আজ্ঞা কর শ্রীনিবাস।
যবনেরে সবংশেতে করিব বিনাশ।।

শুনে দশরথ কয় বিশ্বাস না হয়।
কোন হরি ওঢ়াকাঁদি হইল উদয়।।


কিন্তু দেখার পর হরিঠাকুরের বাণী,
কি জানি কি ওঢ়াকাঁদি না হয় প্রত্যয়।
কোথাকার হরি এল ওঢ়াকাঁদি গায়।।
নদীয়াতে গৌররূপে গোলোক-বল্লভ।
ওঢ়াকাঁদি জন্ম তার কিসে অসম্ভব।।

মীন হৈনু, কূর্ম হৈনু, বরাহ নৃসিংহ।
তা হ’তে কি হীন হৈনু ল’য়ে নরদেহ।।
মাতাকে কড়ার দিনু নদীয়া ভুবনে।
করিব মা শেষ লীলা ঐশান্য কোণে।।
এই সেই লীলা এই সেই অবতার।
ইহার উপরে পূর্ণ লীলা নাহি আর।।


প্রভু বলে শেষ লীলা বড় চমৎকার।
লীলাকারী যেই তার নিজে বোঝা ভার।।

যা থাকে কপালে হ’বে হয় হো’ক ক্লেশ।
কোথা হ’তে স্বয়ং এল কলি অবশেষ।।


আর দেখা হওয়ার পর,
তুমি কৃষ্ণ তুমি বিষ্ণু তুমি হর হরি।

সে নারী শ্রীক্ষেত্রে গেল জগন্নাথে আর্তি।
রথের উপরে দেখে হরিচাঁদ মূর্তি।।


নারী বলে কেন আমি আসি এতদূর।
ওঢ়াকাঁদি আছ যদি দয়াল ঠাকুর।।
এই সেই সেই এই ভিন্নভেদ নাই।


প্রভু বলে ওঢ়াকাঁদি আমি হরিদাস।
জগবন্ধু বলে তোর হ’ত কি বিশ্বাস।।
তেঁই তোরে পাঠাইনু শ্রীক্ষেত্র উৎকলে।


ঘৃণা মহাপাপ স্পর্শে পালের হৃদয়।

সেই পাপে অগ্নিতাপ হীনতেজ হয়।।
ব্রহ্মতেজ বিষ্ণুতেজ অগ্নিতেজ জ্বলে।
সব তেজ নষ্ট হয় আমাকে নিন্দিলে।।


গুরুকে না চিনে বেটা করে গুরুগিরি।
অহংকারী গুরুকার্যে নহে অধিকারী।।


প্রভু বলে সেই আমি ভাব যদি তাই।

সেই আমি যদি তোরা সেই পঞ্চ ভাই।।



এই পঞ্চ ভাই তোরা দ্বাপর লীলায়।
শেষে ভবানন্দ পুত্র আমি নদীয়ায়।।
যুগে যুগে ভক্ত তোরা হইলি আমার।
এবে তোরা পঞ্চ পুত্র শঙ্কর বালার।।

আমাদের এই মাতা সেই মাতা হ’লে।
দেখিয়া চিনিত মোরে করিতেন কোলে।।
প্রভু রাম পূজিলেন দুঃখের সময়।
মাল্যবাণ পর্বতে মা হ’লেন উদয়।।

সেই শ্রীগৌরাঙ্গ মোর এল ওঢ়াকাঁদি।
নমঃশূদ্র কুলে অবতার গুণনিধি।।
যশোমন্ত রূপে জীবে ভক্তি শিখাইল।
জয় হরিচাঁদ জয় সবে মিলে বল।।

মহাপ্রভু বলে আমি ছিনু নদীয়ায়।
চেন কিনা চেন আমি শচীর তনয়।।


তুমি দিগ্বিজয় ছিলে কেশব কাশ্মীরী।
আমি সেই বালক নিমাই গৌর হরি।।

সেই তুমি, তুমি সেই, আমি দিগ্বিজয়।
তুমি প্রভু সর্বেশ্বর শচীর তনয়।।

অদোষ দরশি তুমি বিষ্ণুপ্রিয়া কান্ত।

পরিধান পীতবাস যেন কাল শশী।
ত্রিভঙ্গ ভঙ্গিমা বাঁকা হাতে আছে বাঁশী।।
বনমালা গলে দোলে বক্ষদেশ ঢাকা।
চরণে চরণ দিয়ে হ’য়ে আছে বাঁকা।

মস্তকেতে শিখি পাখা শ্রীপদে নুপুর।
এইমত রূপে আছে শ্রীহরি ঠাকুর।।

অপার মহিমা প্রভু পূর্ণ অবতার।
প্রশস্থ গার্হস্থ্য ধর্ম এল শিখাবার।।
অবনীতে অবতীর্ণ ভব কর্ণধার।
করিলেন শেষ লীলা অতি চমৎকার।।

তবে একদিন আমি কুরুক্ষেত্র রণে।।


অর্জুনের সারথি ছিলাম যে সময়।
হনু বলে প্রভু আর সহ্য নাহি হয়।।
যদি আজ্ঞা করিতেন প্রভু ভগবান।
একটানে ফেলাতাম কর্ণের রথ খান।।


প্রভুকে দেখিয়া বলে চিনেছি তোমায়।
ফাঁকি দিয়া লুকাইয়া এসেছ হেথায়।।
শ্রীধাম উৎকলে আছ দারুব্রহ্ম মূর্তি।
তাহাতে তোমাতে এক পরমার্থ আর্তি।।
তুমি তিনি অভেদ আমরা নহে চিনি।
আদেশে জানা’লে প্রভু তাই মোরা জানি।।

পাণ্ডা কহে তুমি হও নন্দের নন্দন।
ত্রেতাযুগে করেছিলে রাবণ নিধন।।
এবে ওঢ়াকাঁদি এসে পাতকী তরা’লে।
জগন্নাথ আবেশেতে জনম লভিলে।।


কৃষ্ণ আবেশেতে প্রভু কৈল গোষ্ঠলীলে।
শ্রীগৌরাঙ্গ আবেশেতে হরিনাম দিলে।।
তিন শক্তি আবির্ভূত এক দেহ ধরি।
করিলে মানুষ লীলা মধুর মাধুরী।।

প্রভু বলে এ রস কৌতুক বুঝিবি কি।
ব্রজ রস পাত্র এ ব্রজের শুকপাখী।।
ব্রজে ছিল সারী শুক শালিক হ’য়েছে।
পূর্বের সাহসে মোর উরুতে বসেছে।।

এ ভাবে বসিবে কেন, না থাকিলে চেনা।
জনমে জনমে থাকে নয়নে নিশানা।।
তমালের ডালে ছিল কোকিলার মেলা।
সারী-শুক বকুলের ডালে করে খেলা।।


বৃন্দাবনে দেখিয়াছি এই সব লীলা।
এই সেই বৃন্দাবন তমালের তলা।।
গোকুলে জন্মিল কৃষ্ণ নন্দঘোষ ঘরে।
বৃন্দাবনে বাস করিলেন গিয়া পরে।।

মায়াপুরী জন্মে হরি শ্রীগৌরাঙ্গরূপে।
লীলা করে গুপ্ত বৃন্দাবন নবদ্বীপে।।
বুঝিয়া দেখিলে এই সেই সেই ভাব।
সফলাডাঙ্গায় ওঢ়াকাঁদি লীলা সব।।

রাম ভরতের পুনরাগমন খণ্ডে বলা হল,
প্রশস্ত গার্হস্থ্য ধর্ম জীবে শিক্ষা দিতে।
হরিচাঁদ অবতীর্ণ হন অবনীতে।।

ব্রাহ্মণ কায়স্থ সাহা শূদ্র সাধু নর।
ছত্রিশ বর্ণের লোক হ’ল একত্তর।।
দ্বিজ নমঃশূদ্র ছিল অকর্মে পতিত।
পতিত পাবন তার করিবারে হিত।।

পঞ্চ অংশে বঙ্গদেশে শেষ লীলা জন্য।
হরিচাঁদ নাম ল’য়ে হ’ল অবতীর্ণ।।

এ সময় আচম্বিতে শব্দ এক হয়।


শূন্য হ’তে শুনা গেল দৈববাণী প্রায়।।

Post a Comment

আপনার মেসেজের জন্য ধন্যবাদ, আপনাদের সকল মেসেজ গুলি আমি দেখি, ব্যাস্ততার জন্য অনেক সময় উত্তর দেওয়া সম্ভব হয়না, আশা করি সময় করে সবার উত্তর দিবো,, ধন্যবাদ সাথে থাকার জন্য

Previous Post Next Post

Popular Posts