দুষ্টু বালক ও কুমিরের খাজ কাটা লেজের গল্প

ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)।।
বিমানের ড্যাশ-৮টি মাত্র চট্রগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের প্রশস্ত রানওয়ে থেকে টেকঅফ করলো। নিচে কর্ণফুলীর বিস্তীর্ণ জলরাশি আর তাতে অসংখ্য অজস্র কার্গো শিপের আনাগোনা। একটি গতিশীল অর্থনীতির প্রধানতম সমুদ্রবন্দরের এরিয়াল ভিউটা যেমন হওয়া উচিত ঠিক তেমনই। আগে সিংগাপুর বা হংকং বিমান বন্দরে অবতরণের সময় বন্দরমুখী জাহাজের কাফেলা দেখে মনটা খারাপ হতো। আমাদের চট্রগ্রাম বন্দরমুখী জাহাজের সংখ্যা কখনোই যে ২-১০টির বেশি দেখিনি। আর তা খুব বেশি আগের কথাও না, বড়জোড় ৫-৭ বছর। প্রাইস ওয়াটারহাউজ কুপারস-এর এক সাম্প্রতিক সমীক্ষায় পৃথিবীতে সর্বাধিক প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী দেশের তালিকায় বাংলাদেশের স্থান তিন নম্বরে। প্রথম ও দ্বিতীয় যথাক্রমে চীন ও ভারত।
সামনে ২০১৯-এর আশেপাশে আবারও জাতীয় নির্বাচন। রাজপথে কান পাতলে শোনা যায়  ‘যদি’। যদি আওয়ামী লীগ সরকার আবার ক্ষমতায় ফিরে না আসে? এই যদির মানেটা একেকজনের কাছে একেক রকম। বিএনপি সমর্থকদের কাছে এর অর্থ এক যুগ পর আবারও গণভবনে ঢোকার চাবি। আর আওয়ামী লীগ সমর্থকদের কাছে এর অর্থ হলো আবারও নির্যাতন-নিপীড়নের সাথে নিত্য বসবাস। এতো গেল দলীয় সমর্থকদের কাছে যদি’র কি মানে। কিন্তু সাধারণ মানুষ? কি ভাবছেন তারা? পেশায় আমি লিভারের চিকিৎসক। দেশের একটি প্রধান হাসপাতালে আমার চাকরি আর অন্য একটি জনপ্রিয় বেসরকারী হাসপাতালে আমার সান্ধ্যকালীন কর্মযজ্ঞ। আর আমার যে বিশেষায়িত কর্মক্ষেত্র, এদেশে সে রোগের প্রকৃত-অপ্রকৃত রোগীর সংখ্যাও প্রচুর। অপ্রকৃত লিভার রোগী হচ্ছেন তারা যারা যকৃতের কোনো ব্যধিতে আক্রান্ত না হয়েও যকৃতের যন্ত্রণায় অতি কাতর। নিজের ঢোল বাজানো অবশ্য এই পর্যায়ে আলোচনার উদ্দেশ্য নয়। আর বাজালে তাতে দোষেরই বা কি? আজকাল নিজের ঢোল নিজেই না পেটালে মানুষ নাকি ভালোভাবে শুনতে পায় না। ভাবছি এ নিয়ে সামনে লিখব।
এই পর্যায়ে প্রসঙ্গটা টেনে আনার উদ্দেশ্য সাধারণ মানুষের মনোভাব তুলে ধরার নিজের অবস্থানগত যৌক্তিকতা প্রমাণের চেষ্টা করা। প্রতিদির রোগী ও রোগী সংশ্লিষ্ট শতাধিক মানুষের সাথে আমার কথা বলার সুযোগ হয়। আর এই সুযোগে আমি বুঝতে চেষ্টা করি আদর্শিক ও রাজনৈতিক নানা বিষয়ে তাদের মতামত। আমার এই অভ্যাসটা অনেক পুরাতন। এই লম্বা-চওড়া ব্যাখ্যার পটভূমিতে আমার ধারণা ২০১৯-এ সরকার পরিবর্তনের কোনো ধারণাই সাধারণ মানুষের ধ্যান-ধারণায় নেই। আর যদি কেউ আলোচনার স্বার্থে ‘যদি’-কে ঠিক ধরে নেন, তাহলে? এই তাহলে-র ব্যাখ্যাটা খুব সুখকর কিছু নয়। সাধারণ মানুষের কাছে এই ‘তাহলে’ আর ‘স্থবিরতা’ একে-অপরের সমার্থক। কারণটাও সোজা-সাপ্টা। বিএনপি নেতৃত্বের অপরিণামদর্শী ও আত্মবিধ্বংসী নীতি ও রাজনীতি থেকে এটা পরিষ্কার যে তাদের হাতে ‘অনিরাপদ বাংলাদেশ’।
উদাহরণ চাইলে দেয়া যাবে ভুড়ি-ভুড়ি। এরা সেই দল যারা দেশের নিরাপত্তা  বিঘ্নিত হওয়ার জুজুর ভয়ে বিনে পয়সায় আসা সাবমেরিন কেবল ফিরিয়ে দিয়েছিল। পাটের রিভাইভালের জোয়ারে আজ যখন উল্লসিত আমরা সবাই, ভাবতে অবাক লাগে, একদিন এরাই পৃথিবীর বৃহত্তম আদমজী জুট মিল গুড়িয়ে দিয়ে সমস্ত যন্ত্রপাতি স্ক্র্যাপ মেটাল হিসেবে বিক্রি করে দিয়েছিল। সরকারের অন্ধ বিরোধিতায় এরা ঢাকায় অনুষ্ঠিত শতাধিক দেশের নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের সংগঠন ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের সম্মেলনকে অবলীলায় বলে দেন প্রহসন। বুঝুন তাহলে!
তবে যারা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা করেন তারা চিন্তিত অন্য আশংকায়। বিএনপির ক্ষমতায় ফিরে না আসার বাস্তবতা বুঝতে পেরে অতি ডান একটি গোষ্ঠী ঝুঁকছে আরো ডানে, ঝুঁকছে জঙ্গিবাদের দিকে। দেশের জন্য এটি একটি অশনি সংকেত। ভিনদেশি আদালত স্বীকৃত একটি জঙ্গিবাদী রাজনৈতিক দলকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা খুবই সম্ভব। এর প্রমাণ আমরা দেখেছি ২০১৪ আর ২০১৫-এর আগুন সন্ত্রাসের দিনগুলোতে। কিন্তু সমাজ বিচ্ছিন্ন কিছু মাথা মোটা লোক কিংবা বিভ্রান্ত কিছু ধর্ম ব্যবসায়ী- তাদের ব্যাপারে রাষ্ট্রের কিইবা করণীয়। রাষ্ট্র যা পারে তা সে করছে এবং করেছেও অত্যন্ত দক্ষতার সাথেই। পশ্চিমারা যা করে দেখাতে পারেনি, তাই করে দেখিয়েছে আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র।
কিন্তু সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে, রাষ্ট্রের অলিতে গলিতে আর আমাদের রান্নাঘরে আর বৈঠকখানায় আজ মৌলবাদ আর পশ্চাদপদতার যে অনুপ্রবেশ তা ঠেকানো কোনো সরকার বা রাষ্ট্রের একার কাজ নয়। এর জন্য প্রয়োজন জনসচেতনতা আর গণপ্রতিরোধ। নিরবিচ্ছিন্নভাবে এই প্রতিরোধের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে হলে একটা ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই। আর বিকল্পহীন এই দূরূহ লক্ষ্য অর্জনে সব ধর্মনিরপেক্ষ আর প্রগতিশীল শক্তির শর্তহীন ঐক্য ও পারষ্পরিক সহযোগিতারও কোনো বিকল্প নেই। লেখার শুরুতে বলছিলাম চট্রগ্রাম সফরের কথা। চট্রগ্রামে আমার এবারের আসাটা ছিল মাল্টি-ডাইমেনশনাল। একাধারে একাডেমিক ও সাংগঠনিক, সাথে কিছুটা সামাজিকও।
চট্রগ্রামে নামার পর প্রথম মিশন ছিল প্রজেক্ট লন্ডন- ১৯৭১-এর সাথে যৌথভাবে চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটে আয়োজিত ‘লন্ডন ১৯৭১’ শিরোনামে একটি স্থিরচিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধনীতে যোগদান। ১৯৭১ ব্রিটেন প্রবাসী বাঙ্গালীদের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা দেশে ও প্রবাসে আরেকবার মনে করিয়ে দেওয়াই এই প্রদর্শনীর উদ্দেশ্য। দেশপ্রেম ও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শে উজ্জ্বীবীত হয়ে প্রবাসের বাঙ্গালিরা সেদিন ‘যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে’ যার যার মত করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। মিছিলে কাঁপিয়েছিলেন ট্রাফালগার স্কয়ার, হাইড পার্কসহ লন্ডনের রাজপথ। অনশন করেছেন ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে বৃটেনের প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের সামনে। বাংলাদেশের গণহত্যা নিয়ে এপ্রিলের শুরুতেই ব্রিটিশ পার্লামেন্টে আলোচনাও হয়েছে তাদের চাপেই। লন্ডন ১৯৭১-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশিষ্টজনদের আলোচনায় উঠে এসেছে এমনি অনেক না জানা স্মৃতি।
একজন উজ্জ্বল দাস – পেশায় সাংবাদিক, আট বছর ধরে লন্ডন প্রবাসী। ঘুরে ঘুরে সংগ্রহ করেছেন অমূল্য এসব ছবি। আর সেসব নিয়েই একর পর এক প্রদর্শনী ঢাকায় শিল্পকলা একাডেমী আর ব্রিটিশ কাউন্সিলে আর সিলেট হয়ে এবার চট্রগ্রামে। লন্ডন ১৯৭১ -এ প্রদর্শনীগুলোর একটি বৈশিষ্ট্য হল এটি প্রজেক্ট লন্ডন ১৯৭১-এর সাথে সমমনা বেশকটি সংগঠনের যৌথ প্রয়াস। এতে যেমন আছে বাংলাদেশ সরকারের সংষ্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় আর ব্রিটিশ কাউন্সিলের পৃষ্ঠপোষকতা, তেমনি লম্বা এই তালিকায় আছে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটি, আমরা করবো জয়, ব্রিকলেন আর আমাদের বাংলাদেশ স্টাডি ট্রাষ্টের নামও।
শেখ হাসিনার নেতুত্বে বাংলাদেশের আজকের ও আগামীকালের যে অর্জন তা উগ্রবাদের সুনামিতে কোনো একদিন হঠাৎ যেন হারিয়ে না যায় তা নিশ্চিত করতে পারে শুধুমাত্র একটি কুসংস্কার, ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশই। বাংলাদেশ যে একদিন ইরাক, লিবিয়া বা সিরিয়া হবে না তা নিশ্চিত করায় সব ধর্মনিরপেক্ষ, প্রগতিশীল শক্তির যে সহযোগিতার কথা বলছিলাম তারই একটি ছোট্ট উদাহরণ লন্ডন ১৯৭১ শিরোনামের স্থিরচিত্র প্রদর্শনীগুলো। হতে পারে উদ্যোগ হিসেবে এগুলো অতি সামান্য কিন্তু এমনি অসংখ্য সামান্যই একসাথে জন্মদেয় অসামান্যের। সরকারের কাঁধে সব বোঝা তুলে না দিয়ে তাই আমাদের নিজেদেরটুকু নিজেদেরই করতে হবে দায়িত্ব নিয়ে।
অনুষ্ঠানটির উদ্বোধনীতে বক্তব্য রাখতে গিয়ে আমার মনে পড়ছিল দুষ্টু সেই বালকের কথা যে কুমিরের রচনা লিখতে গিয়ে লিখেছিল, “… … কুমির একটি উভচর প্রাণি, এর আছে দুটি বিশাল চোয়াল, অজস্র ধারালো দাঁত আর কুমিরের লেজ খাজ কাটা, খাজ কাটা … …”। পরের বার নদীর রচনা লিখতে গিয়ে সে লিখল, “… … নদীটি খুবই খরস্রোতা। নদীতে কুমির থাকে। … … আর কুমিরের লেজ খাজ কাটা, খাজ কাটা … …”। আরো পরে যখন তাকে গরু নিয়ে রচনা লিখতে বলা হল, সে লিখল, “… … গরু একটি গৃহপালিত প্রাণী। গরু নদীর ধারে ঘাস খায়। নদীতে কুমির থাকে। … … আর কুমিরের লেজ খাজ কাটা, খাজ কাটা … …”।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধকালীন গণহত্যা, ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে হত্যাকাণ্ড, ২১শে আগস্টের গ্রেনেড হামলা কিংবা সাম্প্রতিক সময়ে হলি আর্টিজান আর শোলাকিয়া- এসব একই সূত্রে গাঁথা। আর এসবের একটিই উদ্দেশ্য যা হল জন্ম মুহূর্ত থেকেই একে একটি অকার্যকর রাষ্ট্র পরিণত করা। সমস্যা হচ্ছে যোগসূত্রের এই ধরণ আর ধারণাটা অনেকেরই অপছন্দের। এসব নিয়ে কথা বলতে গেলে অনেকের কাছেই তা দুষ্টু বালকের কুমিরের খাজ কাটা লেজের গল্পের মত মনে হয়। মনে রাখতে হবে দুষ্টু বালক বলুক চাই নাই বলুক – কুমিরের লেজ কিন্তু খাজ কাটাই। আর সেটাই বাস্তবতা। অতএব সাধু সাবধান!
Earn Money Online

https://dailynewstimesbd.com/

Post a Comment

আপনার মেসেজের জন্য ধন্যবাদ, আপনাদের সকল মেসেজ গুলি আমি দেখি, ব্যাস্ততার জন্য অনেক সময় উত্তর দেওয়া সম্ভব হয়না, আশা করি সময় করে সবার উত্তর দিবো,, ধন্যবাদ সাথে থাকার জন্য

Previous Post Next Post

Popular Posts