উত্তর পশ্চিম সিরিয়ায় এক বিমান হামলায় ৩৩ জন তুর্কি সৈন্য নিহত হওয়ার পর একে কেন্দ্র করে ওই অঞ্চলে চরম উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
ঘটনার পরই তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান আংকারায় এক উচ্চ পর্যায়ে নিরাপত্তা বৈঠক করেন এবং তুরস্কের বাহিনী সিরিয়ার ২০০টি লক্ষ্যবস্তুর ওপর স্থল ও বিমান হামলা শুরু করে। এতে ৩০৯ জন সিরিয়ান সৈন্যকে 'নির্মূল' করা হয়েছে এবং ৫টি হেলিকপ্টার, ২৩টি ট্যাংক, ২৩টি হাওইটজার এবং দুটি বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করা হয়েছে বলে তুরস্ক দাবি করছে।
তুরস্কের সংবাদমাধ্যমে দৃশ্যতঃ সিরিয়ান সামরিক যানে বিস্ফোরণের ছবি দেখানো হয়েছে।
এ ঘটনাকে কেন বিপদজনক বলে মনে করা হচ্ছে?
গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই সিরিয়ার সরকারি বাহিনী ইদলিব প্রদেশ পুনর্দখলের জন্য রাশিয়ার সামরিক সমর্থন নিয়ে ব্যাপক যুদ্ধ চালাচ্ছে।
ইদলিব হচ্ছে সিরিয়ার ভেতরে বাশার আসাদবিরোধী বিদ্রোহীদের সবশেষ ঘাঁটি। এখানে একাধিক তুরস্ক-সমর্থিত সিরিয়ান বিদ্রোহী, জিহাদি ও আল-কায়েদা সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠী আছে।
যে কারণে পরিস্থিতি জটিল আকার নিচ্ছে তা হলো, তুরস্ক হচ্ছে মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট নেটোর গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। অন্যদিকে সিরিয়ার বাশার আসাদ সরকারের মিত্র হচ্ছে অপর পরাশক্তি রাশিয়া।
তাই তুরস্ক আক্রান্ত হলে ইদলিবের যুদ্ধে পরাশক্তিগুলো জড়িয়ে পড়ে কিনা - সেই আশংকা বেড়ে যাচ্ছে।
ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের শীর্ষ কূটনীতিক জোসেপ বোরেল বলেছেন, সিরিয়ায় একটি বড় আকারের আন্তর্জাতিক সামরিক সংঘাতের ঝুঁকি বেড়ে গেছে।
কাদের বিমান হামলায় নিহত হলো তুর্কি সৈন্যরা?
খবরে জানা যাচ্ছে, ইদলিব প্রদেশে বাশার আসাদ-বিরোধী বাহিনী সারাকেব নামে একটি শহর দখল করে নেয়ার পর ওই বিমান হামলা চালানো হয়। সেখানে তুর্কি সৈন্যরা জিহাদি যোদ্ধাদের পাশে নিয়ে যুদ্ধ করছিল বলে বলা হয়, যদিও তুরস্ক তা অস্বীকার করছে।
তুরস্কের হাতায় প্রদেশের গভর্নর রাহমি ডোগান বলেছেন, "আসাদের বাহিনীর বিমান হামলায় আমাদের ৩৩ জন সৈন্য শহীদ হয়েছেন।"
তিনি যদিও বলছেন সিরিয়ান বাহিনীর কথা - কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব বিমান হামলা চালায় বাশার আসাদের মিত্র রুশ বাহিনী।
কিন্তু রাশিয়া বলেছে, বালিউন নামে ওই এলাকায় রুশ বাহিনী যুদ্ধ করছিল না।
তাহলে বালিউন এলাকায় আসলে কী ঘটেছিল?
রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, বালিউন এলাকায় তুর্কি সৈন্যরা তাদের ভাষায় "সন্ত্রাসীদের" সাথে মিলে যুদ্ধরত থাকার সময় এক "বোমাবর্ষণে" নিহত হয়।
এখানে হায়াত তাহরির আল-শাম গোষ্ঠী বা সাবেক আল-নুসরা বাহিনীর যোদ্ধারা - সিরিয়ার সরকারি বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালাচ্ছিল।
রাশিয়া বলছে, ইদলিবে যাতে তুরস্কের সৈন্যরা আক্রান্ত না হয় - সে জন্য তারা সব সময় তুরস্কের সাথে যোগাযোগ রেখে চলছিল। কিন্তু বালিউন এলাকায় যে তুরস্কের সৈন্যরা সক্রিয় আছে তা তাদের জানানো হয় নি।
রাশিয়া বলেছে, ওই এলাকায় তাদের বিমান কোন আক্রমণ চালাচ্ছিল না। কিন্তু তুরস্কের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেছেন, কোথায় তুরস্কের সৈন্য আছে তা রাশিয়াকে জানানো হয়েছিল এবং আক্রান্ত তুরস্ক সৈন্যদের কাছাকাছি কোন সশস্ত্র গোষ্ঠী ছিল না।
এ পরিস্থিতিতে নেটোর পক্ষ থেকে ইদলিবের সব পক্ষকে যুদ্ধ বন্ধ করতে আহ্বান জানানো হয়েছে।
তা ছাড়া শুক্রবার সকালেই মি. এরদোয়ান ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মধ্যে এক জরুরি টেলিফোন-আলাপ হয়েছে বলেও জানা গেছে।
ইইউ উদ্বিগ্ন: আরো অভিবাসী ঢুকে পড়তে পারে ইউরোপে
তুরস্ক এর আগেই বলেছিল, ইদলিবে তাদের অভিযানের উদ্দেশ্য হচ্ছে উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ায় একটি নিরাপদ এলাকা তৈরি করা - যাতে যুদ্ধের কারণে সিরিয়া থেকে পালাতে থাকা বেসামরিক লোকদের সিরিয়ার ভূখন্ডের ভেতরেই আশ্রয় দেয়া যায় এবং তারা তুরস্কের ভেতরে ঢুকে না পড়ে।
কারণ তুরস্ক বলছে তারা প্রায় ৩৭ লাখ সিরিয়ান অভিবাসীকে আশ্রয় দিয়েছে এবং তাদের দেশে আর কাউকে আশ্রয় দেবার জায়গা নেই।
তুরস্কের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে ইতিমধ্যেই দেখা যাচ্ছে শরণার্থীদের দলগুলো ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে ঢোকার চেষ্টায় তুরস্ক-গ্রীস সীমান্তের দিকে যাচ্ছে।
এর আগেই খবর বেরোয় যে তুরস্ক পশ্চিমা দেশগুলোকে সতর্ক করে দিয়েছে যে ইদলিব অভিযানে তাদের সমর্থন না পেলে - যেভাবে তারা সিরিয়ান অভিবাসীদের ইউরোপে ঢোকা ঠেকিয়ে রেখেছে, তা আর করবে না।
তুরস্কের সরকারি সূত্রে এমন আভাস দেয়া হয়েছিল বলেও খবর বের হয়। তবে তুরস্ক অভিবাসীদের ব্যাপারে তার নীতি পরিবর্তনের কথা অস্বীকার করেছে।
তবে তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলছে, সিরিয়ার ঘটনাবলী তুরস্কের ওপর অভিবাসনের চাপ বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু শত শত সিরিয়ান অভিবাসী গ্রীসের লেসবস দ্বীপে যাবার জন্য সীমান্তের দিকে যাত্রা শুরু করেছে এমন খবরের পর গ্রীস সীমান্তে প্রহরা জোরদার করেছে।
এই গ্রীস দিয়েই ১০ লাখেরও বেশি অভিবাসী ইউরোপ ঢুকেছিল এবং ২০১৫ সালে তুরস্ক ও ইইউর এক চুক্তির অধীনে সেই অভিবাসনের জোয়ার নিয়ন্ত্রণে আনা হয়।
পূর্ণ মাত্রার সংঘাতের পরিস্থিতি?
বিবিসির বিশ্লেষক জোনাথন মার্কাস বলছেন, তুরস্ক এবং সিরিয়ার মধ্যে এখন পূর্ণ-মাত্রার সংঘাতের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
কিন্তু তিনি বলছেন, প্রশ্ন হলো আংকারা বা দামেস্ক এ ক্ষেত্রে পিছু হটবে কিনা। মস্কোকে যদিও এখানে কোন নিরপেক্ষ দেশ বলা যায় না - কিন্তু তারা উত্তেজনা হ্রাসে কোন ভুমিকা রাখবে কি? তারা কি বাশার আসাদ সরকারের ইদলিব পুনর্দখলের অভিযান বন্ধ করতে পারবে?
এ নিয়ে সংশয় আছে কারণ, বাশার আসাদ চাইছেন তিনি সিরিয়ার পুরো ভূখন্ডের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ পুনপ্রতিষ্ঠা করবেন এবং এ কাজে রাশিয়া তাকে বরাবর সাহায্য করে চলেছে।
খবর পাওয়া যাচ্ছে যে ক্রুজ মিসাইল সজ্জিত দুটি রাশিয়ান ফ্রিগেট এখন বসফরাস প্রণালী পার হয়ে ভূমধ্যসাগরের দিকে যাচ্ছে। যদিও মস্কো বলছে, এর সাথে সিরিয়ার ঘটনাবলীর কোন সম্পর্ক নেই।
নেটোর মহাসচিব ইয়েন্স স্টোলটেনবার্গ সিরিয়ার বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে রাশিয়া ও বাশার আসাদের বাহিনীর অভিযান থামাতে বলেছেন। নেটো জোটের পক্ষ থেকে ইদলিবে সামরিক অভিযান বন্ধের আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু দামেস্কের সরকারি কর্মকর্তারা বরেছেন, ইদলিবে তার ভাষায় সন্ত্রাসীদের তৎপরতা দীর্ঘায়িত করতে পশ্চিমাদের কোনো চেষ্টা তারা মেনে নেবে না।
তবে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের একজন মুখপাত্র বলেছেন, রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনকে বলা হয়েছে সিরিয়ার সরকারের সাথে সস্পৃক্ত যে কোন কিছুই তুরস্কের বৈধ টার্গেট, এবং তাদের আঘাত করা হবে। তবে আংকারার অনুরোধে আজই ব্রাসেলসে নেটো জোটের এক জরুরি বৈঠক হতে যাচ্ছে।
বিবিসির বিশ্লেষক জোনাথন মার্কাস বলছেন, এ ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভুমিকা প্রায় দর্শকের মতো হয়ে পড়েছে। কারণ রাশিয়া ছাড়া এখানে উত্তেজনা কমাতে কার্যকর ভুমিকার পালন করার মতো কেউ নেই।
তিনি বলছেন, এতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নীতির ব্যর্থতা বোঝা যায়।
তুরস্ক সিরিয়ার ব্যাপারে এত বেশি জড়িয়ে পড়েছে কেন?
প্রথমত, সিরিয়ার সাথে তুরস্কের দীর্ঘ সীমান্ত আছে। এ ছাড়া প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান বাশার আসাদের কট্টর বিরোধী।
ফলে সিরিয়ার থেকে পালানো মানুষজন তুরস্ককে তাদের স্বাভাবিক গন্তব্য হিসেবে বেছে নিয়েছে।
আরো একটি গভীর কারণ: সিরিয়ায় যে কুর্দি জনগোষ্ঠী আছে তারা যেন বাশার আসাদবিরোধী বিদ্রোহের সুযোগে তুরস্ক সীমান্তবর্তী এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে না পারে - সেই চেষ্টা করে চলেছে তুরস্ক। কারণ আংকারার ভয়, এর ফলে তুরস্কের ভেতরকার কুর্দি জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিদ্রোহের উস্কানি তৈরি হবে। তাই তুরস্ক চায়, সীমান্ত এলাকা থেকে কুর্দিদের তাড়িয়ে অন্য প্রায় ২০ লাখ সিরিয়ানদের সেখানে পুনর্বাসিত করতে। সূত্র: বিবিসি বাংলা
Source: Bangaldesh protidin
Tags:
• আন্তর্জাতিক