মানুষিক সমস্যা আমাদের দৈনন্দিন সমাজের একটি কমন রোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই বলে মানুষিক অসুস্থতার মানেই 'পাগলামি' না। আমাদের চারপাশে এমন অগণিত মানুষিক রোগী ঘুরে বেড়াচ্ছে যারা বাইরে যথেষ্ট সুস্থ, স্বাভাবিক, যারা আপনার সঙ্গে এক টেবিলে বসে চা পান করবে, রাজনীতি বা সমাজব্যবস্থা নিয়ে সুগভীর আলোচনা করবে, আপনি ঘুণাক্ষরেও টের পাবেন না তার ভেতরের অস্থিরতার। বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে অকস্মাৎ এদের অসুস্থ সত্তাটি বাইরে বেরিয়ে আসে। অনেক সময় অসুস্থতার শিকার এই ব্যক্তিরা পারস্পরিক ব্যক্তিগত ও সামাজিক সম্পর্কগুলো নষ্টের পেছনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। এতে তাদের দোষ দেয়া যায় না। তারা নেহাৎ অসুস্থ, শারীরিক অসুস্থদের মতো তাদেরও প্রয়োজন স্বাস্থ্যগত সাহায্য। আসুন জেনে নেই মানসিক অসুস্থতার কিছু লক্ষণ
:- স্থূলতা
দ্রম্নত মুটিয়ে যাচ্ছেন? বাইপোলার ডিজঅর্ডার বা স্কিৎজোফ্রেনিয়ার মতো মানসিক সমস্যাগুলো তীব্র আকারে যাদের আছে, তাদের কিন্তু স্থূলতা বা মুটিয়ে যাওয়ার প্রবণতা থাকে। বাইপোলার ডিজঅর্ডারে মানুষের আনন্দ ও দুঃখের অনুভূতি দ্রম্নত পরিবর্তিত হতে থাকে; আর স্কিৎজোফ্রেনিয়ায় চিন্তা, অনুভূতি ও ব্যবহারের মধ্যে সমন্বয়হীনতা ঘটার ফলে মানুষ ভুল ধারণা, অযাচিত ব্যবহার এবং বাস্তবতা এড়িয়ে কল্পনার রাজ্যে বাস করতে বাধ্য হয়। স্কিৎজোফ্রেনিয়ার রোগীরা সাধারণ মানুষের তুলনায় ৩.৫% বেশি এবং বাইপোলার ডিজঅর্ডারযুক্ত মানুষরা ১.৫% বেশি স্থূলতার ঝুঁকির মধ্যে থাকেন। আপনার হঠাৎ অস্বাভাবিক ওজন বৃদ্ধি আপনার ভেতরের অশান্ত অবস্থার বহিঃপ্রকাশ নয়তো?
ওজন হারানো
হঠাৎ মুটিয়ে যাওয়া যেমন মানুষিক সমস্যার পরিচায়ক হতে পারে, তেমনি দ্রম্নত ওজন হারানোও হতে পারে অন্যতম শারীরিক লক্ষণ। সাধারণত উদ্বিগ্নতা ও বিষণ্নতায় যারা ভোগেন, তাদের মধ্যে ওজন হারানোর হার বেশি লক্ষ্য করা যায়। স্বাভাবিকভাবেই, দুশ্চিন্তা, উদ্বিগ্নতা ও বিষণ্নতা খাবার গ্রহণের প্রতি রুচি কমিয়ে দেয় এবং খাদ্য পরিপাকেও ব্যাঘাত ঘটায়। তাই আক্রান্ত ব্যক্তিরা দ্রম্নত ওজন হারিয়ে ফেলেন।
বমিভাব দুশ্চিন্তা,
উদ্বিগ্নতা ও বিষণ্নতা যেভাবে খাবারে অরুচি আনে, ঠিক একইভাবে হজমে ব্যাঘাত ঘটিয়ে বমিভাব তৈরি করে। তীব্র কষ্টানুভূতির সময় বমিভাব হওয়া প্রায় স্বাভাবিক ব্যাপার। নরওয়ের একটি সমীক্ষায় ৬২,০০০ মানুষিকভাবে অশান্ত মানুষকে পরীক্ষা করে দেখা গেছে এদের মধ্যে ৪৮% বমিভাবে আক্রান্ত হওয়ার কথা বলেছেন। সুতরাং, শরীর যখন বিদ্রোহ করে বসে, তখন অবশ্যই সে বাড়তি মনোযোগের আকাঙ্ক্ষা করে। মাইগ্রেন মাইগ্রেন ও মানসিক সমস্যাবলি খুব ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। অনেক ক্ষেত্রেই মানসিক বিভিন্ন সমস্যা তীব্র রূপ ধারণ করলে
মাইগ্রেনের মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়। আমাদের দেহে কতিপয় এনজাইম রয়েছে যারা ক্ষতিকর রাসায়নিক সংকেতগুলো মস্তিষ্কে পৌঁছতে বাধা দেয়। অনেক সময় মন অশান্ত থাকাকালে এই এনজাইমসমূহের কার্যকলাপে বিঘ্ন ঘটে এবং মস্তিষ্ক হয়ে পড়ে অরক্ষিত। তখন লাগাতার কষ্টানুভূতির সংকেত পেতে পেতে এক সময় মাথায় তীব্র ব্যথাসহ মাইগ্রেন সৃষ্টি হতে পারে। মাইগ্রেনের রোগীদের ৮৩% এর পেছনে বিষণ্নতা ও উদ্বিগ্নতা দায়ী।
সাইনাস সাইকোলজি টুডে'র মতে, দীর্ঘস্থায়ী সাইনাস সমস্যার সঙ্গে উদ্বিগ্নতা ও বিষণ্নতার সংযোগ রয়েছে। এতে বলা হয়, দীর্ঘকাল ধরে সাইনাসে ভুগছেন এমন মানুষদের এক-চতুর্থাংশ বিষণ্নতার শিকার। আক্রান্ত ব্যক্তির সবসময় মনে হয় মুখমন্ডল এলাকায় কিছু আটকে আছে বা কোনোকিছু চাপ দিচ্ছে। মানসিক সমস্যা শারীরিক সমস্যায় পরিণত হয়ে অশান্তি বৃদ্ধি করার অন্যতম উদাহরণ এই সাইনাস সমস্যা। দীর্ঘমেয়াদি ব্যথা শরীরের ব্যথা আর মনের ব্যথা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িত। এই দু'টোর মধ্যে পরিপূরক সম্পর্ক বিদ্যমান। অনেক ক্ষেত্রেই শারীরিক ব্যথা বিষণ্নতায় রূপ নিতে পারে, আবার একইভাবে বিষণ্নতা শারীরিক ব্যথানুভূতিকে বাড়িয়ে তোলে। হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুল বলে, 'ব্যথা পাওয়া শরীর আর কষ্ট পাওয়া মনের প্রায়শ একই চিকিৎসার প্রয়োজন হয়।'
এরা আরও বলে, যাদের দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক ব্যথা আছে, তারা বিভিন্ন মানসিক সমস্যায় ভোগার ৩ গুণ বেশি ঝুঁকির মধ্যে থাকেন। আবার যারা বিষণ্নতায় ভোগেন, তাদের শরীরে দীর্ঘমেয়াদি ব্যথা শুরু হওয়ার সম্ভাবনা সাধারণের চেয়ে ৩ গুণ বেশি থাকে। তাই মনকে অবহেলা করে শরীরের যত্ন নেয়া শুধু কঠিনই নয়, এক কথায় অসম্ভব। চর্ম সমস্যা অশান্ত মন, অস্থির চিত্ত, দুশ্চিন্তা, অতি চিন্তা ও বিষণ্নতা বিভিন্ন চর্মজনিত সমস্যার উদ্ভব ঘটাতে পারে। মানুষিক অস্থিরতা বা চাপের মুহূর্তে স্ট্রেস হরমোন কর্টিসলের নির্গমন হয়- যা
ত্বকে তেলের নিঃসরণ বাড়িয়ে দেয়। ফলে ব্রণ, একজিমা, র?্যাশ, সোরিয়াসিস, এলার্জিজনিত প্রতিক্রিয়া, চুলকানিসহ বিভিন্ন রকম চর্মঘটিত সমস্যার উদ্ভব করে। তাই উৎকট চর্ম সমস্যাকে অবহেলা না করে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেয়া বাঞ্ছনীয়। ক্যাভিটি একে লক্ষণ না বলে বরং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াই বলা যায়। অদ্ভুত হলেও সত্য, দাঁতের ক্যাভিটি বা গর্ত হয়ে যাওয়ার সঙ্গে বিষণ্নতা ও দুশ্চিন্তার যোগ রয়েছে। আমেরিকার একাডেমি অব জেনারেল ডেন্টিস্টের মতে, বিষণ্নতার মতো মানসিক সমস্যা থেকে শুকনো মুখ, দাঁতের ক্যাভিটি এবং মাড়ির সমস্যার উদ্ভব হতে পারে।
যারা অ্যান্টি-ডিপ্রেসেন্ট নিয়ে থাকেন, তাদের মুখ গহবরের বাড়তি পরিচ্ছন্নতা ও যত্নের ওপর ডাক্তাররা বেশি গুরুত্ব দিতে বলেন। অ্যাড্রেনালিন রাশ যারা জীবনে বারবার দুশ্চিন্তা ও উদ্বিগ্নতার মুখে পড়েছেন, তারা নিশ্চয়ই জানেন যে, এগুলো মানুষিকভাবে উদ্ভূত হলেও কষ্টটা মূলত শরীরের ওপর দিয়েই যায়। অতিরিক্ত নার্ভাসনেসের সময় স্নায়ুতন্ত্র অ্যাড্রেনালিন নিঃসরণের জন্য সংকেত প্রেরণ করে। এর মাধ্যমে শরীর লড়াই করার জন্য বা বিপদ মোকাবিলা করার জন্য তৈরি হয়ে ওঠে।
কিন্তু অ্যাড্রেনালিনের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া হিসেবে হার্টবিটের হার বেড়ে যায়, শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রম্নত ও ছোট ছোট হয়ে পড়ে, বুকে ব্যথা, মাথা ঘোরা এবং পেশিতে টান পড়ে। উপরোক্ত কারণগুলো থাকলে বসে না থেকে অবশ্যই একটি ভালো সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে যেতে পারেন। আপনার মানুষিক অবসাদগুলো খুলে বলুন, উপকার পাবেন।
sourch of jai jai din.
Tags:
• স্বাস্থ্য