শৈশব কৈশোর গ্রামে কাটানো মানুষ আমি। যেখানে ১৫/১৬ তে বিয়ে ছিল অহরহ ঘটনা। ক্লাস নাইন/টেন -এ উঠলেই বিয়ের প্রস্তাব আসাটা ছিল স্বাভাবিক। অভিভাবকদের আশপাশের মানুষ জিজ্ঞেস করতো, মেয়ে তো বড় হয়ে গেছে এখনও বিয়ে দিচ্ছেন না কেন?
এমন অবস্থায় অনেক তথাকথিত শহুরে শিক্ষিত আধুনিক আত্মীয়স্বজনকেও উপদেশ দিতে শুনেছি, মেয়েদের যত অল্প বয়সে বিয়ে হয় ততোই ভালো। বয়স বাড়লে ভালো সম্বন্ধ পাওয়া যাবে না। অনেক প্রতিকূলতা ভেঙে যখন শহরে গিয়েছি অনার্স পড়তে, তখন তো মনে হলো মহা অন্যায় হয়ে গেছে।
“আপনাদের বড় মেয়ের তো গায়ের রং শ্যামলা, ছোটটা বেশি ফর্সা। বড়টাকে এখনও বিয়ে দিচ্ছেন না, শেষে দেখা যাবে পাত্রপক্ষ বড়টা দেখতে এসে ছোটটাকে পছন্দ করবে”, এমন সব উপদেশ যখন আসতো, সত্যি বলতে ভিতরে ভিতরে কুঁকড়ে যেতাম। পরিবারে আদরে শিক্ষায় কখনো ছেলেমেয়ের বিভেদ দেখিনি, বুঝিনি গায়ের রংয়ের পার্থক্য। এগুলো যে কত বড় ইস্যু হতে পারে পরে দেখেছি তা।
তখনকার মানে নব্বইয়ের মাঝামাঝি বা তার কিছু পরও সামাজিক অবস্থাটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এমনই ছিল বিয়েই যেন মেয়েদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। ছেলেদের হতে হবে কর্মক্ষম। সংসারের হাল ধরা ভরণপোষণের ব্যবস্থা করা এসব তাদের দায়িত্ব।

অল্পবয়সে বিয়ে হলে খুব কম মেয়েই পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে। সংসার বাচ্চাকাচ্চা সব সামলে নিজের জন্য সময় বের করা, নিজেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা এবং সেই স্বপ্নের ক্যারিয়ারে নিজেকে নিয়ে যেতে পারা অনেক কঠিন। যারা সেই কঠিন কাজটা পারে না, আবার মাঝপথে এসে যেকোনো কারণে সংসারটাও টিকে না, বা বিধবা হবার মতো দুর্যোগে পতিত হোন, তারা পড়ে যায় আকুল পাথারে। একটা জীবন কত দীর্ঘ কষ্টের অন্ধকার রাতের সমান, তাদের চাইতে কে আর তা ভালো জানে!
এই শতাব্দীতে এসে ভাবছি চেইঞ্জ হলো বুঝি এইসব পুরনো ধ্যান-ধারণার। হ্যাঁ! কিছুটা হয়তো হয়েছে, কিন্তু সেটা মুষ্টিমেয় শিক্ষিত শহুরে আধুনিক সমাজে। সার্বিক অবস্থার খুব একটা বড় পরিবর্তন এখনো আসেনি।
এখনকার যুগে সোশ্যাল মিডিয়ায় অভ্যস্ত কিংবা আসক্ত আমরা সবাই। যখন দেখি উচ্চশিক্ষার সার্টিফিকেটধারী পুরুষও ব্যঙ্গ করে লিখে, ‘পিএইচডি করা পাত্রীর জন্য পাত্র জুটে না সময়ের কাজ সময়ে না করলে এমনই হয় বলে’। আবার এমনও দেখেছি, কমবয়সী সুন্দরী বিয়ে করে গর্বিত হতে। মেয়ে বেশি শিক্ষিত হলেই ঝামেলা বেশি। মেয়েদের শিক্ষিত হওয়া, চাকরি করা ডিভোর্সের হার বাড়ার কারণ, ইত্যাদি ইত্যাদি….
এইসব পুরুষতান্ত্রিক মন মানসিকতার সাথে দুঃখজনক হচ্ছে কিছু মেয়েদের একটিভিটিজ! রুপচর্চা আর হিজাবের স্টাইলে যতটা পারদর্শী, অন্যক্ষেত্রে নয়। কোন মেকাপে চোখটা আরেকটু বড় দেখাবে, নাকটা আরেকটু শার্প লাগবে, চোখের নিচে কালিটা ঢাকা পড়বে, পিম্পলের দাগটা দেখা যাবে না, এসব রপ্ত করে দক্ষ হাতে। টিকটক নামের একটা অ্যাপের বদৌলতে সবাই দেখেছেন ন্যাকামি আর আকর্ষণীয় দেখানোর কসরতে কতোটা এগিয়েছি আমরা!
দোষটা আসলে তাদের না, দোষ আমাদের। বিয়েটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, ক্ষেত্রবিশেষে জীবনের একমাত্র লক্ষ্য নির্ধারণ করি। বিয়ে করতে অতি অবশ্যই ফর্সা, সুন্দরী পাত্রীই চাই। বেশিরভাগ মানুষই সৌন্দর্য জিনিসটাকে গায়ের রং আর ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস দিয়ে পরিমাপ করি। তাইতো ছোটখাটো প্লাস্টিক সার্জারি থেকে শুরু করে ব্রেস্ট ইম্পল্যান্টের মতো সাইড ইফেক্ট সম্পন্ন সার্জারি করেও কেউ কেউ ভাইরাল হবার প্রতিযোগিতায় নামে। কিন্তু এইসব করে আদতে কি সুন্দর হয়? হওয়া সম্ভব? আখেরে লাভ কী?
সৌন্দর্য্য আলাদা কিছু। ছেলেমেয়ে উভয়ের ক্ষেত্রেই সৌন্দর্য্য থাকে মেধা-মননে, ব্যক্তিত্বে, চেষ্টা এবং পরিশ্রমে। পারফেক্ট ফিগার আর গায়ের রং আলাদা অলংকার যোগ করে মাত্র। এর বেশী কিছু না। একজন সফল এবং আত্মনির্ভরশীল মানুষই সুন্দর মানুষ। একজন স্বচ্ছ চিন্তার মানুষই আধুনিক মানুষ।
বলিউড অভিনেত্রী সোনম কাপুরের একটা অতি প্রচলিত ইন্টারভিউ আছে, যাতে তিনি বলেছেন, পারিবারিক এক অনুষ্ঠানে এক আত্মীয়া তাকে দেখে বলেছিল, এতো কালো, এতো লম্বা, একে কে বিয়ে করবে? ১৮ বছর বয়সে যখন প্রথম ডেটে নিমন্ত্রণ জানায় বয়ফ্রেন্ড, সেও পরে অন্য বন্ধুর কাছে বলেছিল, ও ভীষণ মোটা। শুনে খাওয়া-দাওয়াই ছেড়ে দিয়েছিলেন।
সিনেমা জগত, বা গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ডের মেয়েদের সুন্দরী আর আবেদনময়ী হিসেবেই দেখানোর জটিল প্রক্রিয়া নিয়ে তিনি বলেছেন, কত কারসাজি করে কত সময় নিয়ে যে মডেলকে প্রস্তুত করা হয়, সেটা যদি সবাই জানতো! সোনমের প্রসাধনী আর চুল নিয়ে ছ’টা মানুষ কাজ করে, একজন পড়ে থাকে শুধু নখের যত্ন নিয়ে। সপ্তাহে একবার করে চোখের পাপড়ি ডিজাইন করে ছাঁটা হয়।
তার ভাষ্যমতে, “দিন শুরু থেকে রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে পর্যন্ত একটা মানুষের দায়িত্ব থাকে সারাদিনে আমি কী খাবো, কী খাবো না সেসবের চার্ট আমাকে বুঝিয়ে দেয়া, এবং খাওয়ার সময় আমার পাশে থাকা, যাতে ক্যালরির পরিমাণ ঠিক আছে কিনা সেটা সে চেক করতে পারে। যতটুকু না আমি খাই, তার চেয়ে বেশি খাবারের জিনিস ব্যবহার করা হয় আমার মুখের ফেসপ্যাক বানাতে। আমি কী পরে কোন অনুষ্ঠানে যাবো, বিচে যাওয়ার সময় আমার গায়ে কী পোষাক থাকবে, প্লেনে চড়ার সময় আমার আউটফিট কী হবে, এসবকিছু ঠিক করার জন্যে আলাদা একটা টিমই আছে। এতো সবকিছু করার পরেও কিন্তু আমি নিখুঁত সুন্দরী নই, সেটার জন্যে ফটোশপ আছে।
একটা মিথ্যে কল্পনাকে আশ্রয় করে ওর স্বপ্নগুলোকে ডালপালা মেলতে দিও না, ওর ভ্রান্ত বিশ্বাসগুলো খুব যত্নের সাথে ভেঙে দিও। যে স্বপ্নের চারপাশটা কুৎসিত কদাকারে ঢাকা, সেটা পূরণ না হওয়াই তো ভালো।”
মিথ্যে স্বপ্ন কিংবা কল্পনার ফানুস উড়িয়ে জীবনের মূল্যবান সময়গুলো নষ্ট করার মানে হয় না। জীবনকে নিজের হাতে গড়ে নেয়াই কৃতিত্বের। আসলে এই পৃথিবীর কোন কিছুই শুধুমাত্র চেহারা দিয়ে জেতা যায় না। এমনকি সিনেমার নায়িকা হওয়া বা কোন সুন্দরী প্রতিযোগিতাও না। যার মেধা আছে, বুদ্ধি আছে, তার আসলে অন্যের চোখে সুন্দর কিংবা অসুন্দর হওয়ায় তেমন কিছু যায় আসে না। যিনি সেরা তিনি সব কিছুতেই সেরা হবার যোগ্যতা রাখে। সেটা প্রফেশনাল কিংবা পারসোনাল দুই জায়গাতেই।
সুন্দরী নয়, সেরা মানুষ হওয়াটাই আসল। রূপচর্চার চাইতে জ্ঞান চর্চাই উৎকৃষ্ট। মেয়েদের জীবনেও বিয়েটাই একমাত্র লক্ষ্য না। বিয়ে সংসার অবশ্যই করবে কিন্তু নিজেকে যোগ্য করেই। একটা ছেলেকে যেমন জিজ্ঞেস করা হয় ছেলে কী করে? একটা মেয়েকেও তেমনিভাবে জিজ্ঞেস করার সময় এসেছে, মেয়েটা কী করে? পড়াশোনা কী করেছে?
আমি সাজবো, আমি রুপচর্চা করবো সেটা নিজের ভালোলাগার জন্য নিজেকে সুন্দর রাখার জন্য। ভালো বিয়ে হবে, পাত্রপক্ষ পছন্দ করবে কি করবে না সে চিন্তা থেকে নয় নিশ্চয়ই। একটা ছেলে যেমন চাইতে পারে পুরোপুরি স্টাবলিস্ট নাহয়ে বিয়ে করবো না, তেমনি একটা মেয়েও চাইতে পারে শুধুমাত্র ভরনপোষণের জন্য কাউকে বিয়ে করবো না। দুজন মানুষ যখন মন থেকে অনুভব করবে আমরা একসাথে থাকতে চাই, জীবনের বাকি পথ সুখে-দুঃখে পাশাপাশি থেকে ভাগ করে নিতে চাই, একটা পরিবার গড়তে চাই আত্মিক আশ্রয় এবং মানসিক প্রশান্তির জন্যই বিয়ের ব্যাপারটা আসা উচিত। শুধু রান্নাবান্না, বাচ্চা পালা, সামাজিক স্ট্যাটাস বৃদ্ধি কিংবা সামাজিক, আর্থিক নিরাপত্তার বিবেচনায় সে সম্পর্ক তাতে স্বার্থ জড়িয়ে থাকে ওতপ্রোতভাবে। সেই স্বার্থে যখন আঘাত লাগে তখনই সম্পর্কে চিড় ধরে।
বলা হয় চাকা আবিষ্কার মানব সভ্যতাকে এগিয়ে নেবার অন্যতম ধাপ। একটা সাইকেলের দুই চাকা যদি সমান নাহয় সেটা মুখ থুবড়ে পরবেই। আজ নয়তো কাল। সংসার নামক সাইকেল যদি মন-মানসিকতায় চিন্তাভাবনায় সমান নাহয় তো টেনে নেয়া গেলেও যেতে পারে কিন্তু স্বাচ্ছন্দ্যে চলার ধর্ম হারায়।
সৌন্দর্য একটা আপেক্ষিক ব্যাপার, একটা অনুভূতি। সেই অনুভূতি জ্যোছনার আলো দেখেও হতে পারে, সূর্যাস্তের গোধূলী রাঙা আকাশ দেখেও হতে পারে, কোন শিশুর নিষ্পাপ হাসি অথবা মোনালিসার হাসি দেখেও হতে পারে। অতএব কোন দাঁড়িপাল্লায় সৌন্দর্য্যকে পরিমাপ করা যাবে! সুন্দর চেহারা সাময়িক চোখকে প্রশান্তি দেয়, মুগ্ধতা ছড়ায় আপন করে পাওয়ার আকাঙ্খা জাগায় কিন্তু মেধা ছাড়া দীর্ঘমেয়াদে সে মুগ্ধতা বিবর্ণ ফিকে হয়ে যায়।
সুন্দর সম্পর্কের জন্য, একটা জীবন হাতে হাত রেখে এগিয়ে যাবার জন্য সমান মানসিকতা, সমান চিন্তাভাবনা এবং সমান অংশগ্রহণই পারে পরিবার সমাজ তথা বিশ্বকে এগিয়ে নিতে।
Source: womenchapter