বাংলায় নারীর বিজ্ঞান চর্চা ও একজন স্বর্ণকুমারী দেবী



মলি জেনান:

“বিজ্ঞান ও গণিত পুরুষালী বিষয়, নারীদের জন্য নয়।” বা “নারী‘র মেধা কম।” এমন কথা এই উত্তরাধুনিক কালেও প্রায়ই শোনা যায়। এমন ধারণা শুধু আমাদের এই উপমহাদেশেই নয়, বরং পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেই সকল সময়েই বিদ্যমান ছিল, আছে। কিন্তু কবে থেকে নারী, বিজ্ঞান ও গণিতকে এমন স্টেরিওটাইপ করা হয়েছে তা সুনির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। তবে সভ্যতার সূচনাকালে নারী ও পুরুষের মধ্যে সাম্য ও সৌহার্দের সম্পর্ক ছিল। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় আধুনিক সভ্যতার গোড়াপত্তন ঘটলেও নারীর প্রতি বৈষম্য ও অবমূল্যায়নের সূত্রপাতও ঘটে এসময়।

আধুনিক সভ্যতার ঊষালগ্নে যারা জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সভ্যতা বিনির্মাণে অপরিসীম অবদান রেখেছেন তারাই নারী অধিকার সম্পর্কে ছিলেন সংকীর্ণ। হতে পারে এটা পুরুষের জাত্যাভিমান বা দীর্ঘদিন মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নারী নেতৃত্বে থাকার খেদ মেটাবার উপায়।

আঠারো শতকে পাশ্চাত্যে যখন নারী জাগরণের ঢেউ, যখন নারী তার শিক্ষার অধিকারের জন্য লড়ছে, যখন সোফি জার্মেইন, মেরী কুরী, লাইস মিটনার শুধু মাত্র নারী বলেই বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য পদে পদে জেন্ডার বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন এবং একাগ্রচিত্তে লড়ে যাচ্ছেন, তখন বাংলায় কেবলমাত্র বিজ্ঞানচর্চার শুরু।

১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হওয়া হিন্দু কলেজ, কলিকাতা স্কুলবুক সোসাইটি ও শ্রীরামপুর মিশনের উদ্যোগে বাংলায় বিজ্ঞান চর্চা শুরু হয়। বাংলার তৎকালীন যুব সমাজ ক্রমশ বিজ্ঞানের প্রতি আকৃষ্ট হতে শুরু করে। এই যে ধীরে ধীরে শিক্ষিত যুব সমাজের মধ্যে মাতৃভাষায় বিজ্ঞান চর্চার ইচ্ছে তৈরি হয়, এটাই হিন্দু কলেজের সবচেয়ে বড় কীর্তি।

অন্যদিকে হিন্দু ধর্মের পৌত্তলিক সংস্কার ও গোড়া আচার অনুষ্ঠান বর্জন করে বৈদিক ধর্মের উৎকর্ষে আস্থা রাখেন মহর্ষী দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি বৈদিক ধর্মের উৎকর্ষ বজায় রাখতে এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রসারের কাজে তত্ত্ববোধিনী প্রত্রিকা প্রকাশ করেন। দেবেন্দ্রনাথের দূরদর্শিতার প্রভাবে বাংলায় যুগান্তকারী আলোড়ন ঘটে যায় সবার অলক্ষ্যে, বিজ্ঞান আর পাশ্চাত্যের দুর্বোধ্য বিষয় হিসেবে সাধারণের অধরা থাকে না। তা তত্ত্ববোধিনীর মাধ্যমে পৌঁছে যায় বাঙ্গালীর মননে।

এতো গেল শিক্ষিত যুব সমাজের কথা, কী করছে তখন বাংলার নারীকুল? তখন তারা অশিক্ষা-কুসংস্কারে ডুবে হেঁশেল সামলায় আর সহমরণে যাবার প্রস্তুতি নেয়। বছর বছর সন্তান জন্ম দিয়ে নিজের সংসারে দাস্যবৃত্তি করে কাটায়। ধর্মীয় জুজু, সামাজিক কুসংস্কার আর পুরুষতন্ত্র মিলেমিশে নারীদের অদৃশ্য শিকল পড়িয়ে রাখে- অশিক্ষা, কুশিক্ষা আর দাস্যবৃত্তির শিকল।
তখনকার সমাজে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে মেয়েদের শিক্ষা গ্রহণের বিষয়টা ছিল খড়ের গাঁদায় সুই কুড়াবার মতো বিষয়। উচ্চবিত্ত ও শিক্ষিত পরিবারের মেয়েরা কিছু কিছু শিক্ষার সুযোগ পেতেন, তবে তা একেবারেই স্বাস্থ্য ও গার্হস্থ্য বিষয়ক।

স্বর্ণকুমারী দেবীর এই ছবিটাই পাওয়া গেল গুগল ঘেঁটে
এক কথায়, কতোটা সুনিপূণভাবে গৃহকর্ম করা যায় তার শিক্ষা বা কোন বিশেষ অতিথি এলে কিভাবে ইংরেজি বলে, গান করে ও বিশেষ খাবার পরিবেশন করে মনোরঞ্জন করা যায়, তার শিক্ষা। এই পথটুকুও সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল না। সেই সময়ে শুধু তথাগত গার্হস্থ্য শিক্ষা নয় বরং সকল ধরনের শিক্ষা ও বিজ্ঞান শিক্ষা নিয়ে নিরলস কাজ করে গেছেন একজন নারী, তিনি স্বর্ণকুমারী দেবী।

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চতুর্থ কন্যা স্বর্ণকুমারী দেবী। পারিবারিক শিক্ষা সচেতনতা, বিজ্ঞান চেতনা ও তত্ত্ববোধিনীর আদর্শে উদ্বুদ্ধ স্বর্ণকুমারী দেবীকে আমরা কবি, ঔপন্যাসিক, সংগীতজ্ঞ ও সমাজ সংস্কারক হিসেবেই জানি। অথচ তার যে পরিচয়টিকে সবচেয়ে গুরুত্ব দেবার কথা ছিল তাই থেকে গেছে আড়ালে। তিনি বাংলার প্রথম মহিলা বিজ্ঞান প্রাবন্ধিক, প্রথম পরিভাষা রচয়িতা এবং প্রথম মহিলা বিজ্ঞান প্রচারক। বিজ্ঞানকে সাধারণের বোধগম্য করবার জন্য তিনি ভারতীতে সহজ ভাষায় বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা করতেন এমনকি নিজের ভাষায় যেন বিজ্ঞানের জটিল বিষয়গুলো সহজেই বোধগম্য হয় তাই অনেক পরিভাষা রচনা করেছিলেন।

সম্পাদক হিসেবে ভারতীর দায়িত্ব নেওয়ার পর ১২১৯ এর বৈশাখ মাসের ভারতীর ভূমিকাতে তিনি লিখেছিলে্ন – “ভারতবর্ষীয় মহিলাগন আজকাল বিদ্যানুশীলনে প্রবৃত্ত হইয়াছেন অথচ তাঁহাদের মধ্যে অনেকের ইয়োরোপীয় কোন ভাষার সহিত বিশেষ পরিচয় না থাকায় তাঁহারা বর্তমান কালের বিজ্ঞান শিক্ষা লাভ করিতে অপারগ। তাহা ছাড়া ইংরেজি জানিয়াও অনেক স্ত্রী-পুরুষ অধিক সময়্ বা অর্থ দিয়া বিজ্ঞান আলোচনা করিতে পারেন না, সেই জন্য ভারতীতে সহজ ভাষায় বিবিধ প্রকার বৈজ্ঞানিক বিষয় আলোচনার বিশেষরুপে ইচ্ছা রহিল।”

লেখক: মলি জেনান
মেয়েদের কথা মাথায় রেখে সেই সময়ে সহজ ভাষায় বিজ্ঞান আলোচনার ইচ্ছা প্রকাশ করা এবং পরবর্তিতে একাধিক বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ লিখা এবং বিজ্ঞান লেখা ও পাঠ সহজবোধ্য করতে বাংলায় বিজ্ঞান পরিভাষা রচনাকরা সেই সময়েই শুধু নয় এখনকার সময়েও ব্যাতিক্রম এবং সাহসী পথ চলা। শুধু তাই নয় তার সাহিত্যেও বিজ্ঞানের বিচরণ ছিল চোখে পড়বার মতো। যে সময় মেয়েদের শিক্ষা বলতে বোঝাতো শুধু মাত্র গার্হস্থ্য শিক্ষা সেই সময় স্বর্ণকুমারী দেবী মেয়েদের শিক্ষার ক্ষেত্রে বিজ্ঞান শিক্ষার পরিধি ঘোরটোপের বেড়া পেরিয়ে উন্মুক্ত পৃথিবীর পথে মুক্ত করে দিয়েছিলেন।

তৎকালীন নারীশিক্ষার সীমাবদ্ধতা লক্ষ্য করেই তিনি লেখেন- “স্ত্রীলোক পুরুষের মতো জ্ঞানধর্মে সমান অধিকারী, কেবল দাস্যবৃত্তি ছাড়া তাহাদের জীবনে গুরুতর উদ্দেশ্য আছে- নিজে মানুষ হইতে এবং অন্যকে মনুষ্যত্বের পথে অগ্রসর করিতে তাহারও অধিকার আছে।” তিনি একটা গহীন জঙ্গলে যেন পথ বেঁধে দিলেন, মেয়েদের মননের ক্ষেত্রটা বাড়িয়ে দিতে সক্রিয়ভাবে সহায়তা করলেন।

source: women chapter
Earn Money Online

https://dailynewstimesbd.com/

Post a Comment

আপনার মেসেজের জন্য ধন্যবাদ, আপনাদের সকল মেসেজ গুলি আমি দেখি, ব্যাস্ততার জন্য অনেক সময় উত্তর দেওয়া সম্ভব হয়না, আশা করি সময় করে সবার উত্তর দিবো,, ধন্যবাদ সাথে থাকার জন্য

Previous Post Next Post

Popular Posts